Published :
<span class="center">পলকের পলকে পলকে দুর্নীতি</span>
#<span class="bold"> লুটপাট করতে নেয়া হতো নামধারী প্রকল্প</span>
#<span class="bold"> সিন্ডিকেট সদস্যদের হাতে ছিলো অপকর্মের নাটাই</span>
#<span class="bold"> স্ত্রী কনিকার নামে জমি, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান</span>
# <span class="bold">উন্নয়নের নামে চলনবিলের সর্বনাশ </span>
#<span class="bold">বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে পকেটে রাখতেন পলক</span>
জুনাইদ আহমেদ পলক। প্রতি পলকে পলকে পাল্টে ফেলতেন নিজের রুপ। একজন প্রতিমন্ত্রী হয়ে (সাবেক) দাপটের সাথে তটস্থ রাখতেন প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপি ও আমলাদের। নিজের চালচলনের মতোই খামখেয়ালীতে ভরা ছিলো তার হাতে থাকা বিগত সরকারের গুরুত্বপূর্ন আইসিটি মন্ত্রনালয়। সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতোই এই মন্ত্রনালয়কে নিজের প্রয়োজনে যথেচ্ছা ব্যবহার করেছেন তিনি। পদে পদে ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজি, লুটপাটের প্রকল্প তৈরী, নিয়োগ বানিজ্য ও ভয়ভীতি হুমকি-ধামকি দিয়ে মালিক বনেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার। শুধু পলকের নির্দেশে বিভিন্ন অপকর্ম বাস্তবায়ন করা স্থানীয় (নিজ এলাকার) সিন্ডিকেট সদস্যরাও এখন শতশত কোটি টাকার মালিক। যদিও ৫ আগষ্টের পর থেকেই এরা সকলেই এলাকাছাড়া।
অভিযোগ রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। উন্নয়নের নামে একের এক প্রকল্প তৈরী করে বাজেট থেকে টাকা লোপাট করেছেন। গত কয়েক বছরে এই টাকার পরিমান কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ প্রায় সবটাই তিনি দেশের বাইরে পাচার করেছেন।
<span class="bold">লোপাটের প্রকল্পে লুটপাটের মচ্ছব :</span>
ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অনেক প্রকল্প নেয়া হয়। কিন্তু এর ফল পায়নি দেশের মানুষ। টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতে ২০১০ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এরমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের রয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এতো কিছুর পরেও ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রকৃত সুযোগ-সুবিধা থেকে দেশের জনগণ ছিলো বঞ্চিত। এই খাতের অনিয়মের বিষয়টি ছিলো ওপেন সিক্রেট। বিশেষ করে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোর-জি করার সময় কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন পলক।
তার দুর্নীতির অন্যতম উৎস ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইকেট পার্ক, আইটি পার্ক ইত্যাদি। আইসিটি খাতে উন্নয়নের নামে এসব প্রকল্প ছিলো পলকের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁস। আইসিটি খাতে যেকোনো প্রকল্প নিলেই তার ১৫ শতাংশ দিতে হতো তাকে।
সম্প্রতি মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয় বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বড় অংকের টাকার অনিয়ম পায়। ছয় খাতে এই অনিয়ম গুলো করা হয়। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের হিসাব-সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ সারা দেশে ৯২টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করছে। এর মধ্যে ১৮টি পার্কে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলমান। নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বড় অনিয়ম হয়েছে পার্ক কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না করে অতিরিক্ত অনুদান গ্রহণ করার।
লুটপাটের অংশ হিসেবে কিছু প্রকল্প সমাপ্ত এবং কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। এরমধ্যে প্রযুক্তি ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, ছিটমহলগুলোতে আইসিটি প্রশিক্ষন, ভার্চুয়াল ডেক্সটপ কম্পিউটিং নেটওয়ার্ক ল্যাব স্থাপন, লার্নিং এন্ড আর্নিং প্রশিক্ষন, সম্ভবতা সমীক্ষা প্রকল্প, ইলেক্ট্রনিক নথি ব্যবস্থাপনা, ফ্রিল্রান্সার টু এন্ট্রিপ্রেনিউর উন্নয়ন, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট প্রস্তুতিকরন, ডিজিটাল টকিং বুক তৈরী, জাতীয় পর্যায়ে মোবাইল এপ্লিকেশন উন্নয়ন দক্ষতা, বাড়ি বসে বড়লোক প্রশিক্ষন, সাইবার নিরাপত্তা, ইনোভেশন ফর স্মার্ট গ্রীন বিল্ডিং, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ই-লার্নিং প্লাটফর্ম, ই-শপ কর্মসূচি, মোবাইল গেইম উন্নয়ন, তৃনমূলের তথ্য জানালা কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য।
এরমধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে শুধু মোবাইল গেইম ও এপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পতে জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয় ৩৩০ কোটি টাকা, এটুআই’এ জানুয়ারী ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয় ৮৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে অনলাইনে শিক্ষা প্রকল্পে জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয় ২৭৫ কোটি টাকা।
আইসিটি খাতে লুটপাটের আরো শত শত প্রকল্প করেছিলো পলক। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন প্রকল্পে ৫ হাজার ৯২৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা, প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পে ২৮৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরনে ৪৪২ কোটি ৮৩.১৪ লাখ টাকা, তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরনে ১৫৮ কোটি ৯৬.৬৯ লাখ টাকা, টেলিযোগাযোগ খাতে কানেক্টেট বাংলাদেশ প্রকল্পে ৫০৪ কোটি ৪৩.৩১ লাখ টাকা, এনভায়রনমেন্টাল এবং সোশ্যাল ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক (ইডিজিই) প্রকল্পে ২ হাজার ৫৪১ কোটি ৬৪.৯৭ লাখ টাকা, ভিডিও কনফারেন্সিং শক্তিশালীকরন প্রকল্পে ৪৯৫ কোটি ১.১২ লাখ টাকা। এছাড়াও সবচেয়ে বড় দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে হাইটেক পার্ক প্রকল্প থেকে। শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের ১১টি প্রকল্পে সংশোধিত মিলিয়ে ব্যয় দেখানো হয় ১ হাজার ৩৭০ কোটি ৭৩.৩৯ লাখ টাকা, আইটি/হাইটেক পার্ক স্থাপনে ১ হাজার ৮৪৬ কোটি ৯ লাখ টাকা, বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি প্রকল্পে ৪৩১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, ইকো সিষ্টেম উন্নয়ন প্রকল্পে ৩৫৩ কোটি ৬ লাখ টাকা, ভারত বাংলাদেশ ডিজিটাল সেবা প্রকল্পে ৭৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, শেখ হাসিনা ইন্সটিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি প্রকল্পে ১১’শ ১৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা, শেখ রাসেল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে ৯৩৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে উল্লেখিত প্রকল্পগুলোর মতোই নামধারী আরো শতশত প্রকল্প বানিয়ে লুটপাটের মচ্ছব চালিয়েছে পলক সিন্ডিকেট।
<span class="bold">যে ভাবে রাজনীতিতে পলক :</span>
সিংড়ার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৬ সালের তৎকালীন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে শেখ হাসিনার বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় পলক। পরবর্তীতে মতিয়া চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তার মাধ্যমে শেখ হাসিনার সাথে কথা বলার সুযোগ পান।
২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম, ২০১৮ সালের একাদশ ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি নাটোর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য মনোনীত হন। ২০১৪ সালে দশম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর একাদশ ও দ্বাদশ সংসদেরও একই মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। প্রথমবার এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে করেছিলেন নির্বাচন। প্রতিমন্ত্রী হয়ে আলাদিনের চেরাগ ছিলো তার হাতে।
<span class="bold">ফাইভ ষ্টার সিন্ডিকেট : </span>
দেশে প্রযুক্তি খাতের মাফিয়া বলা হতো জুনাইদ আহমেদ পলককে। তার সাথে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা। তাদের নিকটাত্নীদের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বাড়ি রয়েছে এই দম্পত্তির। তারা মাঝেমধ্যেই সেসব দেশে অবকাশ যাপনের জন্য যেতেন।
অনুসন্ধানকালে জানা গেছে পলক তার অনুগত সিন্ডিকেট সদস্যদের দিয়ে নামে-বেনামে সিংড়া ও আশেপাশের এলাকাতে হাজার হাজার বিঘা জমি কিনেছেন। সেই সঙ্গে চাকরি, বদলি বাণিজ্য, চাঁদাবাজি কমিশন, খাসজমি বরাদ্দসহ অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। নিজ এলাকায় তার তাঁর ফাইভ স্টার নামে একটি সিন্ডিকেট বাহিনী রয়েছে। এই বাহিনীর সদস্যদের একজন হলেন পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি আগে বিড়ি/সিগারেট বিক্রি করতেন। এখন মাটি বালুর ব্যবস্থা, ইটভাটা, গরুর খামার, সরকারি জায়গা দখল করে দোকান বানিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রন, মহাসড়কে চাঁদাবাজি, ডিও ব্যবসা ও সরকারি শতাধিক পুকুর/দিঘী দখল করে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
আরেক সদস্য সাজ্জাদ হোসেন আগে আতর-সুরমা টুপির দোকান করতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সিংড়া দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হন। পলকের আস্থাভাজন হবার সুবাদে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদকের পদটিও বাগিয়ে নেন। তিনি এলাকায় ভ‚মিদস্যু হিসেবে পরিচিত। ভ‚য়া দলিল করে অন্যের জমি দখলে সিদ্ধহস্ত সাজ্জাদ পলকের জমি বানিজ্যের মূল কারিগড় ছিলেন। ঐ এলাকার রাজা রমনি কান্ত রায় বাহাদুরের শতশত একর জায়গা (অর্পিত সম্পত্তি) ভ‚য়া দলিল সৃষ্টি করে আতœসাৎ করেন। এছাড়া জমিদার বাগাচি , মজুমদার ও মধু ভাদুরির ৭ থেকে ৮’শ বিঘা জমি ভ‚য়া ওয়ারিশ দেখিয়ে দলিল করে নিতে সহায়তা করেন এই সাজ্জাদ। সিংড়া এলাকায় আবাসন ব্যবসা রয়েছে সাজ্জাদের।
সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য হলেন উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইটালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম। তিনি পলকের মূল পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত। জালিয়াতি করে মহিলা কোটা উপেক্ষা করে ছোট ভাই যুবদলের উপজেলা সেক্রেটারি আনিসুর রহমান লিখনকে নিয়ে দিয়েছেন প্রভাষক পদে চাকরি। সহোদর এই দুইভাই পলকের হয়ে এলাকায় বিচার-শালিশ, পুকুর দখল, নিয়োগ ও বদলী বানিজ্য করেন। উপজেলার চাঁদপুর মহল্লায় রাজপ্রসাদের মতো দুই বাড়ির মালিক এই দুই ভাই। এছাড়া শতশত বিঘা জমি, এক’শর উপরে পুকুর নিয়ে মাছ চাষ, ইটভাটা, অটোরাইস মিলের ব্যবসা রয়েছে তাদের।
আরেক সদস্য ডালিম আহম্মেদ ডন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার বাবা সাবেক কমিশনার মান্নান পুরো এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করেন। পলকের হয়ে গরুর হাট নিয়ন্ত্রন, সরকারি জায়গা দখল করে দোকান ও গোডাউন বানিজ্য, শত বিঘা জমিতে মাছের ঘেড় নির্মান, নদী থেকে অবৈধ ভাবে তুলে বালুর ব্যবসা, ভ‚মিহীনদের ঘর দেয়ার নামে চাঁদা উত্তোলন নিয়ন্ত্রন করে সে।
শেষজন পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেল। সিন্ডিকেটের প্রতিটি সদস্যর সাথে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। এছাড়া আলাদাভাবে তিনি আত্রাই নদীর বালু পয়েন্ট নিয়ন্ত্রন করতেন। অবৈধ ভাবে তোলা এই পয়েন্টে সব সময় শত কোটি টাকার বালুর ষ্টক থাকতো। এছাড়া লিঙ্গইন ও জোরমল্লিকাতে বালুর পয়েন্টগুলোও ছিলো তার। পরিবহন ব্যবসা, ফিলিং ষ্টেশন, গরুর খামার, নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ ছিলো তার উপার্জনের মূল খাত। সিংড়ার অদূরে চলন বিলের মধ্যে হাইটেক পার্ক ঘিরে সে এলাকায় শত শত বিঘা জমি কিনে রাখা ও জমির দালালি, দখলবাজিও করেছে এই রুবেল। বড় বোন আরিফা জেসমিন কনিকার (পলকের স্ত্রী) ব্যবসা ও নগদ টাকা দেখভালের দায়িত্বও ছিলো তার উপরে। বোন-দুলাভাইয়ের দেশের বাইরের আইটি রিলেটেড ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রন ছিলো তার হাতে। তারও ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে দুবাইয়ে। সেখানেই বর্তমানে অবস্থান করছেন তিনি এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে পারিবারিক একাধিক সুত্র।
এ ব্যাপারে কথা বলতে এলাকায় গিয়ে ফাইভ ষ্টার বাহিনীর সদস্যদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তাদের ব্যক্তিগত অফিসগুলো তালাবন্দ অবস্থায় ছিলো। মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সেগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে।
<span class="bold">শিক্ষিকা থেকে হঠাৎ উদ্যোক্তা :</span>
আরিফা জেসমিন কনিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে পলক মন্ত্রী হবার পর তিনি উদ্যোক্তা বনে যান। পরবর্তী তিন-চার বছরের মধ্যেই কনিকার একাউন্টে জমা হতে থাকে কোটি কোটি টাকা। যে কোনো প্রকল্প নিলেই পলকের হয়ে ১৫ শতাংশ টাকা কালেকশনের দায়িত্ব ছিলো কনিকার উপরে। ২০০৮ সালে পলক পরিবারের সম্পদ বলতে ছিল সর্বসাকল্যে ১৫ শতক মাঠের জমি, ব্যাংকে ৫০ হাজার, নগদ ১০ হাজার টাকা, ছিলো। এরপরই এই দম্পত্তি বনে যান ভিশন বিল্ডার্স লিমিটেড কোম্পানির ৮০ ভাগ শেয়ারের মালিক। কনিকার নিজ নামে সিংড়ায় রয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০বিঘা জমি। ঢাকায় রয়েছে ১৫টি ফ্ল্যাট। এসব তথ্য নিশ্চিত করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার নিকটাত্নীয়রা জানান, মাত্র ৬ মাস আগে কনিকা সিংড়ার চোওড়া গ্রামে জামিলা ফয়েজ ফাউন্ডেশনের নামে ৭০ বিঘা জমি ক্রয় করেন। সেখানে আরো শতাধিক বিঘা জমির বায়না করেছেন তিনি। উদ্দেশ্য এই স্থানে বাগানবাড়িসহ পার্ক নির্মান করার। একই ভাবে হাটমুরশন এলাকায় পুলিশের আলোচিত কর্মকর্তা সাকলাইনের কাছে থেকে ৪২ বিঘা জমি ক্রয় করে নেন। এছাড়া নাটোর ডিসি অফিসের সামনে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে কনিকা তার বাবার নামে প্রায় ১ বিঘা জমি ক্রয় করেন। একই ভাবে শিংড়া চাঁদপুর মহল্লার তাইজুল কমিশনারের কাছে থেকে প্রায় ২ কোটি টাকায় এবং বালুয়া বাসুয়া এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফজর আলীর জমি ক্রয় করেন। সিংড়া দহপাড়ে কোটি টাকা মুল্যের একটি বাড়িসহ থানার পশ্চিমে উপশহর এলাকায় অত্যাধুনিক একটি বাড়ি কয়েক কোটি টাকা মূল্যে ক্রয় করেছেন। কনিকার আরো একটি বড় বিনিয়োগ রয়েছে চলনবিল হাইটেক পার্ক সিটি এলাকার চারিপাশে। সেখানে তিনিসহ পলক সিন্ডিকেটের সদস্যরা শত বিঘার উপরে জমি কিনে নেন। এছাড়া আশেপাশের আরো কয়েক’শ বিঘা জমির বায়না করে রেখেছেন তারা।
এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রী পলকের স্ত্রী কনিকা ও শ্যালকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তারা এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তার নিকটাত্নীয় (বিয়াই) সিংড়া বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ২০০৮ সালে পলক তার পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া ৫ শতাংশ জায়গার মালিক ছিলেন। তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা শিক্ষিকা পদে চাকরি করত। এখন তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। এটি আমাদের কাছেও মনে হয় যে, দূর্ণীতি না করে কোন ভাবেই এতো টাকা ইনকাম করা সম্ভব নয়।
<span class="bold">উন্নয়নের নামে চলনবিলের সর্বনাশ : </span>
দেশের বৃহত্তম নাটোরের চলনবিলের মাঝখানে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং কৃষির ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষক ও বিশেষজ্ঞরা।
পলকের একক সিদ্দান্তে চলনবিলের একটি অংশে নির্মান করা হচ্ছে হাইটেক পার্ক, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) এবং টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিএসসি)। এর পাশাপাশি চলনবিলে একটি মিনি স্টেডিয়াম তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে।
চলনবিলের বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, বর্ষা মৌসুমে আশেপাশের গ্রামে স্থায়ি জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আগে চলনবিলের পানি দুটি চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হতো। সরকারের এই উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে একটি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ফসলি জমির বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধ থাকে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রায় ৩ হাজার বিঘা জমি। একই সাথে বিলের স্বাভাবিক পানি প্রবাহেও বিঘ ঘটছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন চলনবিল জীববৈচিত্র রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, চলনবিলে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ হারিয়েছে। ফলে বৃহত্তর চলনবিলের জীবক‚ল, প্রাণিক‚ল বংশ বিস্তারে বাঁধার সৃষ্টি হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রজনন বাধাগস্ত হচ্ছে। তাছাড়া অপরিকল্পিতভাবে বিল ভরাট, ও যত্রতত্র ভাবে উন্নয়ন এবং পুকুর খননে নদ-নদীর সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ায় চলনবিল যথাসময়ে পানি পাচ্ছে না আবার সময় মতো পানিও নামতে পারছে না। হাইটেক পার্ক এলাকায় ব্রিজের মুখ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ায় জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কৃষির ও মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
<span class="bold">বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে পকেটে রাখতেন পলক</span>
সিংড়ার বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিজের পকেটে রেখেছিলেন পলক। বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু নেতাকে টাকা দিয়ে পুষতেন। ফলে পুরো সিংড়ায় বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে করে ফেলেছিলেন বোতলবন্দি। প্রকাশ্যে সুবিধা মতো ওই দলকে ব্যবহার করে নিজের প্রভাব জারি রাখতেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিংড়া বিএনপির সদস্য সচিব দাউদার মাহমুদ পলকের বন্ধু। উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আনোয়ারুল ইসলাম আনু সম্পর্কে তাঁর আপন চাচাশ্বশুর। এ ছাড়া পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আলী আজগর খান গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানে পলকের বাসায় ভূরিভোজে অংশ নেন। এ ছাড়া উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি প্রভাষক এন্তাজ আলী সম্পর্কে পলকের আত্মীয়। পৌর জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আলী আকবর পলকের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে তাঁর পারিবারিক এবং রাজনৈতিক মঞ্চে সশরীরে উপস্থিত থাকতেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব দাউদার মাহমুদ বলেন, ছোট এলাকা। এ কারণে আমরা সবাই একসঙ্গে চলেছি। তবে যার যার রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা ছিল। এখানে বন্ধুর কাছে থেকে টাকা নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।
পৌর জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আলী আকবর বলেন, সিংড়া এলাকায় ৪৩ বছর ধরে মসজিদের ইমামতি করছি। এ কারণে এলাকার সব ধরনের মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কে কোন দল করে সেটি দেখে সম্পর্ক করি না। তবে পলকের সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল।
এদিকে, সিংড়া আওয়ামী লীগে একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে দলেন ত্যাগী নেতাদের পাত্তাই দিতেন না পলক। এলাকার চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাহিনী। বাতিল হওয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করার জন্যও উঠেপড়ে লাগেন। ঢাকার বাসায় সভা করে অন্য কাউকে নির্বাচনে না দাঁড়ানোর নির্দেশনাও দেন। পরে দেলোয়ার হোসেন পাশা নামে আওয়ামী লীগের একজন মনোনয়ন তুললে তাঁকে অপহরণ করে মারধর করা হয়। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এলে দলীয় চাপে শ্যালকের মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়ে নেন পলক।
সিংড়া যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুল হাসান কামরান বলেন, ক্ষমতার দাপটে পলক ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বঞ্চিত করেছেন। নিজস্ব বলয় তৈরি করে রাজনীতি করেছেন। আত্মীয়করণ করে সব সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগি করেছেন। আমার মতো অনেকেই সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছি।
উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শরিফুল ইসলাম বলেন, দুঃসময়ে ছিলাম, তবে দলের সুসময়ে আমাকে এবং আমার মতো অনেক পরীক্ষিত নেতাকে বাদ দিয়ে অযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে দল চালিয়েছে। স্থানীয় সব নির্বাচনে পলকের সিন্ডিকেটের মনোনয়ন দেওয়া হতো।
সিংড়া ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি তাজুল ইসলাম রিপন বলেন, স্থানীয় রাজনীতিতে আমার বাপ-চাচার বড় অবদান আছে। তবে পলক এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবারকে রাজনীতি থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত করা হয়। কাউকে কোনো পদে রাখেননি। পলকের রাজনীতি ছিল জামায়াত-বিএনপি এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শাহজাহান আলীর ছেলে সরফরাজ নেওয়াজ বাবু বলেন, আমার বাবার হাত ধরেই পলকের রাজনীতি শুরু হলেও এমপি হওয়ার পর থেকেই জনপ্রিয় কাউকে কোনো পদে রাখেনি। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি।
